৯ বছরের এই শিশুর পানি পড়া খেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন অনেক নারীরা!

নয় বছরের শিশুটির নাম দিপু। বাবার নাম জানা যায়নি। তবে মায়ের নাম দেলেয়ারা বেগম। ৬ বছর বয়স থেকেই সে দিয়ে আসছে পানিপড়া। আর তা খেয়েই নিঃসন্তান দম্পতিরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন বলে অনেক নারীই দাবি করেছেন।

নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটী ইউনিয়নের সরিষপুর গ্রামের হাজীপাড়ার ঘটনা এটি।

জানা গেছে, দুই সন্তান নিয়ে অন্যের জমিতে টিনের বেড়া করে ঘর দিয়ে আছেন দেলেয়ারা বেগম। স্বামী তাদের ছেড়ে অনেক আগে চলে গেছেন। বিভিন্নস্থানে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন আর কাজ করতে হয় না।

গ্রামের সমসের আলী হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়াশুনা করে কবিরাজ হয় শিশু দিপু। তবে কুরআন পড়া এখনও শুরু হয়নি। দিপুর বয়স ৯ বছর হলেও ৬ বছর বয়স থেকে পানিপড়া দিয়ে আসছে।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিবেশী জহুরুল ইসলামের বউয়ের দীর্ঘদিন থেকে কোনো বাচ্চা হচ্ছিল না। তিন বছর আগে তার বউকে পানিপড়া দেয়া হলে গর্ভধারণ করে এবং বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবারও একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। গত তিন দিন বছর থেকে এ কবিরাজি চিকিৎসা দিয়ে আসছে। তখন তেমন ভিড় ছিল না।

এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা করা হয়নি। যাদের বাচ্চা হয়েছে এবং উপকৃত হয়েছেন তারাই মূলত এ প্রচার প্রচারণা করেছেন।

এদিকে এ ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত নিঃসন্তান দম্পতি ছুটে আসছেন ওই শিশুর বাড়িতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন পানিপড়া নেয়ার জন্য।

গত তিনমাস থেকে কবিরাজ দিপুর কাছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া ও জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত নারী-পুরুষ আসছেন পানিপড়া নিতে। পড়া পানি একজন নারীকে দিনে দুবার খেতে হয় এবং একজন পুরুষকে পড়া মধু দিনে দুবার খেতে হয়। এছাড়া পড়া তেল একজন পুরুষকে দিনে দু’বার শরীরে মাখতে হয়।

এভাবে একজন নারীকে ৩/৫ সপ্তাহ চিকিৎসা নিতে হয়। এরমধ্যে ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা হয় বলে কবিরাজের দাবি। অন্তঃসত্ত্বা হলে ডাক্তার দিয়ে কোনো চিকিৎসা বা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করানো যাবে না বলেও নিষেধ করা হয়। প্রতি শুক্রবার করে পানিপড়া দেয়া হয়ে থাকে।

কবিরাজি চিকিৎসা নিতে খরচ হয় তাবিজ ১৩০ টাকা এবং কবিরাজি ফি ১০ টাকা। যাদের মনোবাসনা পূরণ হয় তারা কবিরাজের বাড়িতে এসে খাসি জবাই করে উপস্থিত সবার মাঝে বিতরণ করেন। গত শুক্রবার ২৮টি খাসি জবাই করা হয়েছে বলেও জানা যায়।

কবিরাজ দিপু

সরেজমিনে দেখা গেছে, নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সরিষপুর গ্রাম। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গ্রামের প্রবেশ পথে রাস্তার দু’ধারে মাইক্রোবাস, অটোচার্জার ও ভ্যান-রিকশা সারি সারি করে রাখা হয়েছে। রাস্তা থেকে দিপু কবিরাজের বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। সেই রাস্তা থেকে মানুষের লাইন শুরু হয়েছে কবিরাজের বাড়ি পর্যন্ত।

ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একটি আম বাগানের মধ্যে টিনের বেড়া দিয়ে তৈরি একটি ঘর ও বারান্দা।

আর এ বারান্দায় বসে পানিপড়া দিচ্ছে শিশু দিপু। তার সামনে একটি দানবাক্স মসজিদের জন্য এবং ঘরের বাইরে আরেকটি দানবাক্স মন্দিরের জন্য। যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা বাক্সে নিজেদের ইচ্ছেমত দান করছেন।

আর এ ঘরের আশপাশে অন্তত দেড় হাজার নারী প্রত্যেকে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাগের মধ্যে আছে একটি করে পানি, তেল ও মধুর বোতল। ওইসব নারীর সঙ্গে এসেছেন অনেকেই। তাদের অনেকেই আম বাগানের মধ্যে চটি (মাদুর) পেতে শুয়ে-বসে আছেন।

আবার অনেকেই রান্নার জন্য খাসি, মুরগি জবাই করছেন। সেই রান্না জোগান দিতে পিয়াজ-রসুন বাছাই করছেন কেউ কেউ।

দিপু কবিরাজের কাছে পানিপড়া নিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে হাজীপাড়ার আম বাগানে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন। তার বাড়ির দরজা থেকে শুরু হয়েছে লাইন। ফজরের নামাজের পর শুরু হয় পানিপড়ে দেয়া। আর এ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক নারী ক্লান্ত হয়ে লাইনের পাশে বসে পড়েছেন। কবিরাজের দরজায় আলম নামে এক যুবক পাহারা দিচ্ছেন।

নারীরা একে একে কবিরাজে কাছে যাচ্ছেন আর ২/৩ মিনিট পর পানিপড়া নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। আলমের মতো এখানে ১৫/২০ জন যুবক বাহির থেকে আসা মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করছেন।

কবিরাজ দিপুর মা দেলেয়ারা বেগম বলেন, দিপু যখন পেটে তখন থেকেই অনেক কিছু উপলদ্ধি করতাম। জন্মের আড়াই মাস বয়সে এক রাতে বাচ্চা সাপের রুপ ধারণ করে। এরপর অনেক ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানো হয়। কবিরাজ বাচ্চার গায়ে হাত দিলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

আমাদের অসহায়ত্ব দেখেই নাকি বাচ্চার ওপর জ্বীনের আছর পড়েছে। তখন কবিরাজরাই বলেন বাচ্চাটিকে আমাদের কিছুই করার নেই। যখন বাচ্চার শরীরে জ্বীনের ভর করে তখন কোনো নিঃসন্তান দম্পতি থাকলে তাকে বাচ্চা জন্মধারণের ক্ষমতা দেয়া হবে বলেও জানানো হয়। এছাড়া কেউ যদি কাউকে কুফরি করে সেটাও ভালো করা যাবে।

এরপর ৬ বছর বয়স থেকে পানিপড়া দিয়ে আসছে। রোগী দেখতে দেখতে বাচ্চা যখন অস্বস্থি বোধ করে তখন একটু দেরি করে বাইরে থেকে ঘুরে এসে আবার দেখা শুরু করে। বৃহস্পতিবার রাতে ছেলের গায়ে যখন ভর করে (জ্বীন হাজির হয়) কুরআনের সবকিছু বলতে পারে।

দুবলহাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, মানুষ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা জানি না। তবে এটা ভুয়া ও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন আসছে। এটা নিয়ে এলাকায় একটা পক্ষ তৈরি হয়েছে। যে কোনো সময় সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে পারে। প্রশাসনকে এ বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।

নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. মুমিনুল হক বলেন, মেডিকেল সাইন্সে বন্ধা নারীর পানিপড়া খেয়ে পেটে বাচ্চা আসে এরকম কোনো নিয়ম নেই।

এছাড়া সাইনটিফিক (বৈজ্ঞানিক) এরকম কোনো বিধানও নেই। যেখানে পানি, মধুপড়া এবং তেলপড়া ব্যবহার করলে পেটে বাচ্চা আসে। যদি এরকম কোনো ঘটনা হয়ে থাকে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

নওগাঁ সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হাই বলেন, ছদ্মবেশে ঘটনাস্থলে (বৃহস্পতিবার) পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। এ রকম চিকিৎসা বন্ধ করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।